হেযবুত তওহীদের অপতৎপরতা : পর্ব১

 


ঈমান আল্লাহর দেয়া শ্রেষ্ঠ নেয়ামত

‎আল্লাহ মানুষকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে সৃষ্টি করেছেন এবং দিয়েছেন অগণিত নেয়ামত। মানুষের জীবন পরিচালনার জন্য তিনি যুগে যুগে প্রেরণ করেছেন লক্ষাধিক নবী ও রাসূল। তাঁদের মাধ্যমে দান করেছেন ইহকাল ও পরকালের জন্য কল্যাণময় জীবনব্যবস্থা। সেই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষে আল্লাহ তা'আলা প্রেরণ করেছেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এবং দান করেছেন মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। আমাদেরকে বানিয়েছেন তাঁর উম্মত এবং দান করেছেন ইসলাম নামক চিরসুন্দর ও কল্যাণময় দ্বীন।

‎আল্লাহর নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য দ্বীন হলো ইসলাম। ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো মত, পথ, দল বা আদর্শ তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা অর্জনের জন্য মুমিন হিসেবে নিঃশর্তভাবে ইসলামের আনুগত্য করা আবশ্যক। ঈমান আল্লাহর প্রদত্ত সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত, যা জান্নাতের সঙ্গে সম্পর্কিত।

‎পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা'আলা বলেন:

‎“যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, তাদেরকে এমন জান্নাতের সুসংবাদ দিন যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত হবে।” (সূরা বাকারা: ২৫)

‎ঈমান হলো ইসলামের ভিত্তি ও মানব জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত। আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ছাড়া মানুষের কোনো ইবাদত গ্রহণযোগ্য হয় না। তাই ঈমান ছাড়া নামাজ, রোজা, হজ, যাকাতসহ কোনো আমলেরই মূল্য নেই। যেহেতু জান্নাত ঈমানের সাথে সম্পর্কিত, তাই ঈমানকে রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বিশুদ্ধ আকিদা ছাড়া ঈমান পরিপূর্ণ হয় না। তাছাড়া বাতিল মতবাদ জানার জন্যও প্রয়োজন বিশুদ্ধ আকিদা ও বিশ্বাসের জ্ঞান। 

‎এক নজরে আমাদের আকিদা ও বিশ্বাস

আল্লাহ সম্পর্কে :

‎আল্লাহ এক, তাঁর কোনো শরিক নেই। তিনি অন্তর্যামী, অদ্বিতীয় । মানবীয় বা অমানবীয় কোনো সৃষ্টির সাদৃশ্য তাঁর সঙ্গে নেই।

‎ফেরেশতা সম্পর্কে:

‎ফেরেশতাগণ আল্লাহর সম্মানিত সৃষ্টি, নূর থেকে সৃষ্ট। তারা পুরুষ বা নারী নন, কাম-ক্রোধ ও লোভ থেকে মুক্ত এবং নিষ্পাপ। তাদের সন্তান-সন্ততি নেই। তারা বিপুল শক্তিশালী ও সংখ্যায় অগণিত।

‎নবী ও রাসূল সম্পর্কে:

‎নবী-রাসূলগণ নিষ্পাপ মানুষ। তারা আল্লাহ বা আল্লাহর পুত্র নন। আল্লাহর বাণী তারা হুবহু মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, বাণী পৌঁছানোয় কোনো ত্রুটি হয়নি। সর্বপ্রথম নবী ছিলেন আদম (আ.) এবং সর্বশেষ নবী হযরত  মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মু‘জিজা শুধুমাত্র নবীগণের মাধ্যমেই সংঘটিত হয়। নবী ব্যতীত অন্য কারো মু‘জিজার দাবি প্রতারণা।

আসমানী কিতাব সম্পর্কে:

‎আল্লাহ ১০৪টি আসমানী কিতাব নাজিল করেছেন—১০০টি সহীফা এবং ৪টি বড় কিতাব। তাওরাত, যাবুর ও ইঞ্জিল আল্লাহর নাজিলকৃত কিতাব হলেও প্রচলিত গ্রন্থগুলো বিকৃত ও মানবসৃষ্ট। কেবল আল-কুরআন অবিকৃত ও সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ, যা কিয়ামত পর্যন্ত মানবতার জন্য হিদায়াত।

‎আখিরাত সম্পর্কে:

‎মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত হতে হবে। দুনিয়ায় করা প্রতিটি কাজের হিসাব দিতে হবে। ঈমানের ভিত্তিতে জান্নাত বা জাহান্নাম নির্ধারিত হবে। কবরের প্রশ্নোত্তর ও আজাব সত্য।

তাকদীর সম্পর্কে:

‎সকল সৃষ্টির কল্যাণ-অকল্যাণ, সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি পূর্বনির্ধারিত এবং সবকিছু আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে।

‎আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস :

‎ইসলামই আল্লাহ প্রদত্ত একমাত্র সত্য দ্বীন।শুধুমাত্র ইসলামের অনুসারীরাই জান্নাতে প্রবেশ করবে।অন্যান্য সব ধর্ম বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য। সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম সমালোচনার ঊর্ধ্বে, তাঁদের প্রতি পূর্ণ সম্মান প্রদর্শন আমাদের ঈমানের অংশ।

‎হেযবুত তওহীদ: গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতার শেষ ঠিকানা

‎"হেযবুত তওহীদ" নামটি শুনলে সাধারণ মানুষ মনে করতে পারে এটি হয়তো তাওহীদের পতাকাবাহী কোনো দ্বীনি সংগঠন, যারা ইসলামের খিদমতে নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করছে। বাস্তবে তারা নিরলসভাবে কাজ করছে ঠিকই, কিন্তু সেটি ইসলামের কল্যাণে নয়—বরং ইসলামকে বিকৃত ও ধ্বংস করার জন্য। ইসলামের পবিত্র নামকে তারা ব্যবহার করেছে একটি খোলস বা ঢাল হিসেবে, যাতে সাধারণ মানুষ প্রতারিত হয়। প্রকৃতপক্ষে হেযবুত তওহীদ হলো এমন এক গোষ্ঠী, যারা ইসলামের মৌলিক রোকনসমূহকে অপব্যাখ্যা ও বিকৃতির মাধ্যমে বিপথে ঠেলে দিয়েছে। আল্লাহর সত্তা থেকে শুরু করে ঈমান, ফেরেশতা, নবী-রাসূল, এমনকি ইসলামের কোনো মৌলিক বিষয়ই তাদের বিকৃত ব্যাখ্যা থেকে রেহাই পায়নি।

‎তাদের লেখনী ও বক্তব্যে এমন ভয়ঙ্কর বিকৃতি প্রকাশ পেয়েছে যে, এক পর্যায়ে তারা আল্লাহকে হিন্দুদের ব্রহ্মার সাথে তুলনা করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর দায়িত্ব ও মিশন সম্পর্কেও করেছে মিথ্যা অভিযোগ ও সন্দেহপ্রকাশ। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে নিয়ে এদের মনগড়া বক্তব্য নিছক পাগলের প্রলাপের চেয়ে কম নয়।

‎এভাবেই নিজেদের কুপ্রবৃত্তি ও কামনার অনুসরণ করতে গিয়ে তারা গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতার গভীর অতল গহ্বরে পতিত হয়েছে। তাদের বিকৃত চিন্তাধারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সেই হাদীসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যেখানে তিনি সতর্ক করে বলেছেন—

‎"আমার উম্মতের শেষ যুগে এমন কিছু লোকের আবির্ভাব ঘটবে, যারা তোমাদের সামনে দ্বীনের নামে এমনসব কথা উপস্থাপন করবে, যা তোমরা কিংবা তোমাদের পূর্বসূরীরাও কখনো শোনোনি। তখন তোমরা তাদের থেকে দূরে থাকবে এবং তাদেরও তোমাদের থেকে দূরে রাখবে।"

‎(সহিহ মুসলিম : হাদিস ১৫, মুসনাদে আহমদ : হাদিস ৮২৫০)

‎হেযবুত তওহীদের বিকৃত মতাদর্শের উৎস

‎হেযবুত তওহীদের চিন্তার শিকড় নিহিত পাকিস্তানের এনায়েতুল্লাহ খান মাশরিকির (মাশরিকি নামে পরিচিত) ভ্রান্ত দর্শনে। তিনি পেশায় ছিলেন একজন গণিতবিদ এবং পড়াশোনা করেছেন ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাইস্ট কলেজে। মাশরিকি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থাকলেও ধর্ম বিষয়ে তার ধারণা ছিল চরমভাবে বিকৃত। তিনি নিজের কল্পনা থেকে "তাযকিয়াহ" নামে কুরআনের একটি তাফসীর লিখেন, যেখানে দ্বীনের মৌলিক বিষয়গুলোকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেন।

‎১৯৩০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন আধা-সামরিক সংগঠন "তেহরিক এ খাকসার", যা অনেকের কাছে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবেও পরিচিত। এই সংগঠনের কর্মীদের তিনি নামাজকে কুচকাওয়াজের মতো সামরিক প্রশিক্ষণ হিসেবে শিখাতেন। তাঁর মতে, নামাজ ছিল মূলত সামরিক প্রশিক্ষণ, আর সব ধর্মই আল্লাহর সৃষ্টির মতো সমান ও বৈপরীত্যহীন। আলেম-উলামাদের প্রতি তার বিদ্বেষ ছিল সুপরিচিত।

‎এই মাশরিকির বিকৃত মতাদর্শের উত্তরাধিকার বহন করে বাংলাদেশের বায়াজীদ খান পন্নী প্রতিষ্ঠা করেন হেযবুত তওহীদ। পন্নী মূলত মাশরিকির মৃত চিন্তাধারাকেই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমদানি করেন। ইসলামের বিপরীতে দাঁড়ানো, ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসকে ভ্রান্ত ব্যাখ্যায় উপস্থাপন করা এবং দ্বীনের মৌলিক রোকনসমূহকে বিকৃত করা—এই ছিল তাদের আদর্শ। মাশরিকিই হেযবুত তওহীদের মূল চিন্তাগুরু। 



0 Comments

Post a Comment

Post a Comment (0)

Previous Post Next Post