সিরাত থেকে শিক্ষা : পর্ব-৬


অমুসলিমদের জন্য দুআ – একটি বিলুপ্তপ্রায় সুন্নাহ

‎দুআ হচ্ছে প্রার্থনা, বিনয়ভরে নিজের রবকে ডেকে নেওয়া, তাঁর দরবারে অন্তরের কথা পেশ করা। দুআ বান্দা ও প্রভুর মধ্যে এক অন্তরঙ্গ আলাপ, এক আত্মিক যোগাযোগ। যখন বান্দা দুআ করে, তখন সে আসলে নিজের অসহায়ত্ব স্বীকার করে। সে সমস্ত উপায়-উপকরণ ত্যাগ করে, সকল ভরসা ও শক্তিকে অস্বীকার করে একমাত্র মহান আল্লাহর দিকে ফিরে আসে। নিজের দুর্বলতা, দীনতা ও অভাবের কথা সে খোলাখুলি প্রকাশ করে।

‎হাদীস শরীফে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুআকে বলেছেন “ইবাদতের মগজ” — কারণ দুআর মধ্যেই ইবাদতের মূল সত্তা প্রকাশ পায়। এই মুহূর্তে বান্দা সম্পূর্ণভাবে নিজের অহংকার ভেঙে আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণ করে। বরং হাদীসে আরও এসেছে, “দুআই ইবাদত” — অর্থাৎ দুআই ইবাদতের আসল রূপ ও সর্বোচ্চ স্তর। কারণ, ইবাদতের প্রতিটি রূপে যেমন আল্লাহর প্রতি একাগ্রতা ও নির্ভরতা প্রকাশ পায়, দুআয় তা সবচেয়ে গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়।

‎দুআ হচ্ছে মুমিনের জীবনের প্রাণশক্তি। এটি বিশ্বাসের দৃঢ়তা বাড়ায়, হৃদয়কে শান্ত করে, আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ককে মজবুত করে তোলে। দুআর মাধ্যমে বান্দা বুঝতে পারে—তার কোনো শক্তি নেই, একমাত্র শক্তি আল্লাহর কাছেই। রাসুলুল্লাহ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন সময় অমুসলিমদের হেদায়েতের জন্য দুআ করেছেন। কিন্তু বর্তমানে এটি প্রায় বিলুপ্তপ্রায়।

‎হজরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে কোনো ব্যক্তি আল্লাহর কাছে কোনো দুআ করলে আল্লাহ তাআলা হয়ত সেই দুআ কবুল করেন অথবা কোনো বিপদকে তার ওপর থেকে দূরে সরিয়ে দেন, যদি সে কোনো গুনাহের অথবা আত্মীয়তার সম্পর্কচ্ছেদের জন্য দুআ না করে।’

‎(মিশকাত ২২৩৬, তিরমিজি)

‎সীরাতে অমুসলিমদের হেদায়েতের দুআ

‎হেদায়েত এমন এক নিয়ামত, যা আল্লাহ তায়ালা যাকে চান তাকেই দান করেন। আর এ হেদায়েত লাভের সবচেয়ে শক্তিশালী ও অব্যর্থ হাতিয়ার হলো দুআ । আল্লাহর নিকট হৃদয়ের গভীরতা থেকে আহ্বানই মানুষের অন্তরকে আলোকিত করতে পারে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে আমরা দুআর মাধ্যমে বহু মানুষকে হেদায়েতপ্রাপ্ত হতে দেখেছি। নিচে তেমনই দুটি অনন্য উদাহরণ তুলে ধরা হলো।

‎১. ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর ইসলাম গ্রহণ

‎আরব জাহানের অন্যতম তেজস্বী ও দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্ব ছিলেন ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু। তার চরিত্রে ছিল কঠোরতা ও অদম্য সাহস। একদিন ক্রোধে অন্ধ হয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন— মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যা করবেন। হাতে উন্মুক্ত তরবারি নিয়ে তিনি রওনা হলেন সেই অভিশপ্ত কাজে।

‎কিন্তু পথে জানতে পারলেন, তার আপন বোন ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহা এবং ভগ্নিপতি সাঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণ করেছেন। খবরটি শুনে তিনি প্রচণ্ড রাগে ফুঁসে উঠে বোনের বাড়ির দিকে ধাবিত হন। সেখানে গিয়ে শুনলেন, তারা কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করছেন। রাগের মাথায় বোনকে আঘাত করলেন, রক্ত ঝরতে শুরু করল। কিন্তু সেই আহত অবস্থাতেও বোন উচ্চারণ করলেন, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ”।

‎এই দৃশ্য ও বাক্য ওমরের হৃদয়কে নাড়িয়ে দিল। তিনি পবিত্র হয়ে বোনের কাছ থেকে কুরআনের অংশ—সূরা ত্ব-হা থেকে কয়েকটি আয়াত পড়লেন। তাঁর মুখে তখন শুধুই বিস্ময়, “এটা তো সত্যিই মহান ও সম্মানিত বাণী।”

‎অতঃপর বললেন, “আমাকে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে চলো।”এই সময় গোপনে উপস্থিত ছিলেন খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু আনহু। তিনি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন,“ওমর! খুশি হও। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গত বৃহস্পতিবার রাতে তোমার জন্যই দোয়া করেছিলেন—‘হে আল্লাহ! ইসলামকে শক্তিশালী করুন ওমর ইবনুল খাত্তাব অথবা আবু জাহল ইবন হিশামের মাধ্যমে।’'

‎অবশেষে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে উপস্থিত হয়ে ঈমানের সাক্ষ্য প্রদান করেন। দোয়ার বরকতেই কঠোর হৃদয়ের এই মানুষ পরিণত হন ইসলামের দুর্গে।

‎ ( সিরাত ইবনে হিশাম,আর রাহীকুল মাখতুম)


‎২. আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহুর মায়ের হেদায়েত

‎ইয়েমেনের দাউস গোত্রের এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘনিষ্ঠ সাহাবি ছিলেন। তিনি হিজরত করে মদীনায় এসে সর্বদা নবীজির সান্নিধ্যে থেকেছেন। তাঁর জীবনে মা ছাড়া আর কোনো আপনজন ছিলেন না, তাই মাকেই তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন ও ইসলামের দাওয়াত দিতেন।

‎কিন্তু তাঁর মা প্রথমে ইসলাম গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করতেন। বরং একদিন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্পর্কে এমন কটু কথা বললেন, যা শুনে আবু হুরাইরার হৃদয় ভেঙে গেল। তিনি ব্যথিত হৃদয়ে নবীজির দরবারে হাজির হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,“ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! আমার মায়ের জন্য দোয়া করুন যেন আল্লাহ তাঁকে হেদায়েত দান করেন।”

‎নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সস্নেহে হাত তুলে দোয়া করলেন,“আল্লাহুম্মাহদি উম্মা আবী হুরাইরাহ।”“হে আল্লাহ! আবু হুরাইরার মাকে হেদায়েত দান করুন।”

দোয়া শেষ হতেই আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু দ্রুত বাড়ির দিকে রওনা হলেন। পৌঁছে দেখলেন, তাঁর মা ভিতর থেকে বলছেন, “বাবা, একটু বাইরে অপেক্ষা করো।”তিনি কিছুক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করলেন। কিছু পর তাঁর মা বেরিয়ে এলেন, সম্পূর্ণ পবিত্র অবস্থায়। মুখে উচ্চারণ করলেন,“আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ।”

‎আবু হুরাইরার আনন্দে চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। নবীজির দোয়ার বরকতে সেই মা ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নিলেন।(মুসলিম শরিফ :২৪৯১)

‎বর্তমান সময়ের শিক্ষা ও প্রাসঙ্গিকতা

‎নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুআর ঘটনাগুলো থেকে আমরা শিক্ষা পাই—হেদায়েত আল্লাহর হাতে, আর দুআ তার প্রধান মাধ্যম। আজকের যুগে যখন ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণা ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছে, তখন অমুসলিমদের জন্য দুআ করা এক বিলুপ্তপ্রায় সুন্নাহ হয়ে গেছে। অথচ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও আবু হুরাইরার মায়ের জন্য দুআ করেছিলেন, তেমনি আমাদেরও উচিত সেই দুআর আমলকে পুনর্জীবিত করা।

‎বর্তমানে আমরা দাওয়াতকে শুধু কথা, যুক্তি ও আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছি। কিন্তু বাস্তবে দাওয়াতের প্রাণশক্তি হলো দুআ। এক মুমিন যখন হৃদয়ের গভীরতা থেকে দুআ করে, তখন তার সেই আন্তরিক আহ্বান অনেক সময় মানুষের অন্তরকে নরম করে দেয়, যেভাবে নবীজির দুআর প্রভাবে কঠোর হৃদয়ের ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলামের দুর্গে পরিণত হন।

‎দুআ হচ্ছে এমন এক দাওয়াত, যার কোনো ভাষা বা সীমা নেই। যে দেশে মুখে দাওয়াত দেওয়া কঠিন, সেখানেও দুআর মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে আলো পৌঁছানো যায়। এজন্য প্রত্যেক দাঈর উচিত তার দাওয়াতি প্রচেষ্টার সঙ্গে দুআকে যুক্ত করা। কারণ কথার প্রভাব সাময়িক হতে পারে, কিন্তু দুআর প্রভাব হৃদয়ে স্থায়ী ছাপ ফেলে।

‎এ ঘটনাগুলো আরও শেখায়—পরিবারের জন্য দুআই দাওয়াতের প্রথম ধাপ। যেমন আবু হুরাইরার মায়ের হৃদয় নবীজির দুআয় পরিবর্তিত হয়। আজ আমাদের সমাজেও এমন বহু মা-বাবা, সন্তান বা আত্মীয় আছেন যারা হেদায়েতের বাইরে আছেন। তাদের জন্য ভালোবাসা ও দুআ নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত।

‎ আমাদের দাওয়াত, শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের সব প্রচেষ্টার ভিত হওয়া উচিত এই দুআ। নবীজির দুআ যেমন যুগ বদলেছে, তেমনি আজও আন্তরিক দুআর মাধ্যমেই অন্ধকার হৃদয়গুলোতে হেদায়েতের আলো ছড়িয়ে পড়তে পারে। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সহায় হোন। আমিন!



0 Comments

Post a Comment

Post a Comment (0)

Previous Post Next Post