আহ্বান

 পর্ব -২


জাহিলিয়াতের ছায়া: মদ ও জুয়ার বিষাক্ত ফাঁদে যুবসমাজ

 এক নতুন জাহিলিয়াতের অভ্যুদয়

ইতিহাসের প্রতিটি যুগে কিছু ব্যাধি থাকে যা সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। ইসলামের আগমনের পূর্ববর্তী ‘জাহিলি যুগ’ ছিল এমনই এক সময়, যেখানে অজ্ঞতা, পাপ, এবং পাশবিকতা ছিল সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সে সময়কার সমাজে মদপান ও জুয়া শুধু বিনোদনের উপকরণ ছিল না, বরং তা ছিল পুরুষত্ব, সম্মান ও আনন্দের প্রতীক। অথচ এই দুই অভিশপ্ত কার্যকলাপের কারণেই ভেঙে পড়েছিল পরিবার, ধ্বংস হয়েছিল অর্থনীতি এবং সর্বোপরি লুপ্ত হয়েছিল মানবিকতা।

আধুনিক পৃথিবীতে আমরা টেকনোলজি, শিক্ষার বিস্তার আর নগরায়ণের অভূতপূর্ব অগ্রগতি দেখছি।মানুষের জীবন পূর্বের তুলনায় অনেক সহজ ও স্বস্তিদায়ক হচ্ছে।  বদলে যাচ্ছে জীবনের দৃশ্যপট। জীবনের এত সব উন্নতি ও অগ্রগতি ঘটলেও টেকনোলজি, শিল্পায়ন ও নগরায়নের সঙ্গে সঙ্গে  এক  জাহিলিয়াতও চুপি চুপি ফিরে এসেছে আমাদের সমাজে। আর তা হচ্ছে মদ ও জুয়ার বিষাক্ত নেশা। এই দুই উপাদান ধ্বংস করেছে অসংখ্য পরিবার, যুবক, জাতি ও সভ্যতা। আজকের প্রেক্ষাপট যেন হুবহু সেই জাহিলি সমাজের প্রতিচ্ছবি।

 জাহিলি সমাজে মদ ও জুয়ার ভয়াবহতা

‎জাহিলি আরব সমাজে মদের প্রচলন ছিল ভয়াবহ পর্যায়ে। মানুষ দিনের শুরু করত মদ দিয়ে, শেষ করত মদ দিয়ে। সামাজিক সমাবেশ, বিয়ে, বিজয় উৎসব, এমনকি শোকও পালিত হতো মদপানে। কবিরা তাদের কবিতায় মদের প্রশংসা করতো এবং সাহস ও মর্যাদার পরিচায়ক হিসেবে মদপানকে গণ্য করা হতো।

আরবের প্রতিটি গৃহেই ছিল মদের পাত্র। আবু লাহাব থেকে শুরু করে আবু জাহল, এমনকি কিছু পরবর্তীতে মুসলিম হওয়া সাহাবাও ইসলাম পূর্ব জীবনে মদপানে অভ্যস্ত ছিলেন। সাহাবি উমর ইবনে খাত্তাব রা. নিজেই বলেছিলেন, "আমরা মদকে পানি হিসেবে ব্যবহার করতাম, আমাদের ঘুম, আনন্দ ও দুঃখে মদই ছিল সাথী।"

জাহিলি সমাজে জুয়ার ক্ষেত্রেও ছিল একই অবস্থা।সেসময় ‘মাইসার’ নামে একপ্রকার  জুয়া প্রচলিত ছিল। এটা ছিল  মাংস ও সম্পদ ভাগাভাগির এক নির্মম খেলা। ধনী ব্যক্তিরা উট কেটে তার মাংস ভাগ করত তীর ছুঁড়ে, যার ভাগ্যে পড়তো, সে নিত। আর যার ভাগ্যে পড়তো না, সে কিছু পেত না বরং ক্ষতিগ্রস্ত হতো। এতে সমাজে হিংসা, হানাহানি ও দারিদ্র্য বাড়ত।

‎জহিলি সমাজের লোকেরা  উটের ওপরও জুয়া খেলত। তারা দশজন মিলে একটি উট কেটে জুয়া খেলে তার মাংস ভাগ করত। যে হেরে যেত, পুরো উটের দাম দিত কিন্তু একটি টুকরোও পেত না। এতে সম্পর্ক নষ্ট হত, হিংসা জন্মাত এবং সমাজে শত্রুতা ছড়াত।

 বর্তমান সমাজে মদ ও জুয়ার বিস্তার:

‎বর্তমানে বাংলাদেশের শহর থেকে গ্রামে সর্বত্রই মদের কড়াল গ্রাস হানা দিয়েছে। বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিমপ্রধান দেশে আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি, ফ্ল্যাট কালচার, ফ্যাশন শো, ডেটিং পার্টি, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও মদের প্রবেশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জাতিসংঘের WHO রিপোর্ট (২০২২) অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ মদজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করে। তরুণ সমাজ ফান, এঞ্জয়, ফ্রি লাইফ নামক দর্শনের নামে নিজেদের জীবন ধ্বংস করছে।মদের ব্র্যান্ডিং হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।ইউটিউব, মিউজিক ভিডিওতে মদকে cool দেখানো হয়।

বর্তমানে জুয়া শুধু খেলাধুলার বেটিং নয়, বরং অনলাইন ক্যাসিনো, স্পোর্টস বেটিং অ্যাপস, ক্রিপ্টো জুয়া, ফেইসবুক রাফেল ড্র, এমনকি মোবাইল গেম (যেমন: পাবজি, ফ্রি ফায়ার)-এর মধ্যেও জুয়া ঢুকে পড়েছে। বিশ্বব্যাপী জুয়ার ইন্ডাস্ট্রির আয় ২০২৩ সালে প্রায় ৬৫০ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে (সূত্র: Statista, ২০২৩)। ঢাকায় ২০২৩ সালে অনলাইন জুয়ার কারণে অন্তত ১৫ জন আত্মহত্যা করেছে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মদ ও জুয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম

মদ ও জুয়ার বিরুদ্ধে কুরআনের ধাপে ধাপে নিষেধাজ্ঞা আসে। প্রথমে ইঙ্গিত ও সতর্কতা, পরে নিষেধাজ্ঞা এবং শেষে কঠোর হারাম ঘোষণা।

‎প্রথম ধাপে, তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলো, এতে রয়েছে মহাপাপ এবং মানুষের জন্য কিছু উপকারও আছে, কিন্তু এর পাপ উপকার অপেক্ষা অধিক।( সূরা বাকারা: ২১৯)

এরপর দ্বিতীয় ধাপে মুসলিমদের সালাতের সময় মদপান নিষিদ্ধ করা হয়- হে মুমিনগণ! তোমরা মদ্যপ অবস্থায় সালাতের ধারে-কাছে যেয়ো না, যতক্ষণ না বুঝতে পারো তোমরা কী বলছো। (সূরা নিসা: ৪৩)

‎সবশেষে চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় মদ ও জুয়াকে। হে ঈমানদারগণ! নিঃসন্দেহে মদ, জুয়া, মূর্তি, ভাগ্য নির্ধারণকারী তীর শয়তানের অপবিত্র কাজ; সুতরাং এগুলো থেকে বেঁচে থাকো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।(সূরা মায়িদা: ৯০)

মদ নিষিদ্ধের কথা শোনা মাত্রই সাহাবায়ে কেরাম রা.নিজেদের সংগ্রহে থাকা মদ রাস্তায় ঢেলে দেন,মদের পাতিল ভেঙে ফেলেন। আনাস রা. বর্ণনা করেন, আমি আবু তালহার রা.এর গৃহে মদ ঢালছিলাম। তখন কেউ এসে জানাল যে, মদ হারাম করে দেওয়া হয়েছে। তখনই আবু তালহা রা. বললেন, ‘ও আনাস! এই সব মদ ফেলে দাও।’ আমরা সেই মদ রাস্তায় ঢেলে দিই।

তাছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাহিলি সমাজে তাঁর শৈশব,কৈশোর ও যৌবনের সময় পার করলেও কখনও মদ ও জুয়ার ধারে কাছেও যাননি।

কয়েকটি পরিসংখ্যান

১. (2023):প্রায় ৩০ মিলিয়ন মানুষ মারা যায় মাদক-জনিত সমস্যায়।মদের সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনা ও আত্মহত্যা সম্পর্ক রয়েছে উচ্চ মাত্রায়।


‎২. (২০২২):বিশ্বব্যাপী জুয়ার বাজার প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ইউরো। ৩৫% তরুণেরা অনলাইনে জুয়ার ফাঁদে পড়ছে।


‎৩ . Daily Star, ১২ অক্টোবর ২০২৩ : ঢাকায় অনলাইন জুয়ার গেমে আসক্ত হয়ে কিশোর আত্মহত্যা করেছে। ফোনে তার ‘সাটা খেলা’-এর অ্যাপ পাওয়া গেছে।”


‎৪. প্রথম আলো , ২০ মার্চ ২০২৪ : নতুন প্রজন্মে মদ ও মাদকদ্রব্য ব্যবহার ৪৭% বেড়েছে গত পাঁচ বছরে। তরুণদের বড় অংশ হুকা-লাউঞ্জ ও নাইট-আউট ঘিরে বিপথগামী।” 


‎৫. Bdnews24.com, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ : ইংরেজি মিডিয়াম কলেজের শিক্ষার্থী ‘ফ্যান্টাসি গেমে’ বাজি খেলতে খেলতে ১৫ লাখ টাকা হারায়।


সমাজে এর কুফল:

‎১. নৈতিক অবক্ষয়: মদ ও জুয়ার কারণে চরিত্র বিনষ্ট হয়, অশ্লীলতা, চুরি, খুনের প্রবণতা বেড়ে যায়।

‎২. অর্থনৈতিক ধ্বংস: জুয়ায় সর্বস্ব হারিয়ে মানুষ আত্মহত্যা করছে।

‎৩. পরিবার ভাঙন: সংসার ভেঙে যাচ্ছে, স্ত্রী-সন্তান রাস্তায় নেমে যাচ্ছে।

‎৫. স্বাস্থ্যগত বিপর্যয়: লিভার সিরোসিস, মানসিক সমস্যা, আত্মহনন—সবই মদের কারণ।


‎মদ ও জুয়া এই দুটি দানব শুধু ইসলাম বিরোধী নয়, বরং মানবতার শত্রু। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  এর জীবন আমাদের দেখিয়েছে কিভাবে একটি সমাজকে এ থেকে মুক্ত করা যায়। আমাদের প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব, নিজে এ থেকে দূরে থাকা এবং অন্যকেও সচেতন করা। না হলে এই পাপ শুধু ব্যক্তি নয়, জাতিকে ধ্বংস করবে।

‎হাদীসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি বলেছেন, যে ব্যক্তি এই দুনিয়াতে নেশা করে মরবে,কেয়ামতের দিন সে জাহান্নামে তৃষ্ণায় কাতর থাকবে। (মুসলিম: ২০০৩)

‎নিশ্চয়ই মদ সকল পাপের মূল।(তিরমিজি: ১৮৬২)

করণীয়:

‎ ১. আল্লাহভীতি ও তাকওয়ার চর্চা।

‎ ২. সাংবাদিকতা ও মিডিয়ায় সচেতনতা।

‎ ৩. ইসলামী শরিয়াহ ভিত্তিক আইন চালু করলে এই পাপ রোধ করা সম্ভব।

‎৪. ইসলামী শিক্ষার প্রসার শিশু-কিশোরদের মধ্যে ইসলামি মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে।

‎ ৫. তওবা ও রুজু :যারা এই পাপে লিপ্ত, তাদের উচিত, আল্লাহর দরবারে অনুশোচনায় ভেঙে পড়া এবং ফিরে আসা।

‎৬. পরিবারের দায়িত্ব হচ্ছে সন্তানের বন্ধুদের খোঁজ রাখা,সময়মতো ইসলামী শিক্ষা দেওয়া,মদ ও জুয়ার ভয়াবহতা  শেখানো।


‎★ জাহিলিয়াত নয়, হিদায়াতের পথে ফিরে আসো!

‎প্রিয় যুবক, আজ তোমার সামনে হাজারো রাস্তা খোলা। কিন্তু মদ ও জুয়ার পথে হেঁটে তুমি কেবল ধ্বংসকেই আহ্বান করছ। ইসলাম তোমাকে দিয়েছে শান্তির পথ, সম্মানের জীবন ও আল্লাহর ভালোবাসা। তোমার জীবনের গল্প হোক সাহাবীদের মতো। নেশার ঘোর থেকে ফিরে এসে তুমি হতে পারো সমাজের আদর্শ। মনে রেখো, নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  তোমার জন্য কাঁদতেন, তাঁর সীরাত তোমার মুক্তির চাবিকাঠি। ফিরে এসো মহান রবের পথে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে আল্লাহকে ভয় করে,আল্লাহ তার জন্যে উত্তরণের পথ করে দেবেন।

‎আর তাকে এমন উৎস থেকে রিযিক দেবেন যা সে ধারণাও করে না।

‎[সূরা তালাক:২,৩]

0 Comments

Post a Comment

Post a Comment (0)

Previous Post Next Post