আহ্বান

র্ব : ৩

‎ওহীর নূর : স্রোতের বিপরীতে চলাই আসল বীরত্ব

ইতিহাসের পাতা খুললেই দেখা যায়, সত্য ও ন্যায়ের পথে চলা কখনোই সহজ ছিল না। বিশেষ করে যখন পুরো সমাজ ভ্রান্ত বিশ্বাস, অন্যায় আর কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত, তখন সেই স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আলোর বাতি জ্বালানোই ছিল সর্বোচ্চ বীরত্বের কাজ। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বীরত্বের অম্লান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ওহীর নূরের মাধ্যমে তিনি অন্ধকার যুগে মানুষের অন্তরকে আলোকিত করেছিলেন এবং একাই দাঁড়িয়েছিলেন গোটা সমাজের প্রচলিত অন্যায়, অবিচার আর বাতিল প্রথার বিরুদ্ধে।

জাহিলিয়াতের অন্ধকার যুগ

মক্কার বুকে এক সময় এমন এক সমাজ ছিল, যাকে ইতিহাস জাহিলিয়াতের যুগ নামে চিহ্নিত করেছে। সেই সমাজে সভ্যতার বাহ্যিক চাকচিক্য থাকলেও অন্তর ছিল অন্ধকারে ঢাকা, হৃদয় জুড়ে ছিল হিংসা, অহংকার আর কুসংস্কারের শেকল। আরবের লোকেরা বীরত্ব বলতেই বুঝত শক্তি ও প্রতিশোধ, গৌরব বলতে বুঝত রক্তের সম্পর্ক আর গোত্রীয় অহংকার। অর্থনীতির চালিকাশক্তি ছিল সুদ, জুয়া ও লুণ্ঠন। কাবা ঘর ছিল, কিন্তু সেখানে আল্লাহর একত্ববাদ ভুলে গিয়ে বসানো হয়েছিল ৩৬০টি মূর্তি। তারা সেই মূর্তির কাছে সন্তান কামনা করত, যুদ্ধের আগে জয়ের আশীর্বাদ চাইত, আবার বিপদে পড়লে সেই মূর্তির কাছেই কান্নাকাটি করত। অথচ তাদের হৃদয় থেকে হারিয়ে গিয়েছিল দয়ামায়া, ন্যায়বোধ, আত্মসমালোচনা আর আল্লাহর প্রতি নিঃশর্ত ভালোবাসা।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রথম আঘাত

সেই সমাজে সবচেয়ে বড় মাপকাঠি ছিল গোত্র, বংশ আর সম্পদ। যে বেশি ধনী, যে বড় গোত্রের, তার কথাই সত্য বলে ধরা হতো। গরিব, দাস, নারীদের কোনো সম্মান ছিল না। কন্যা সন্তান জন্মালে পরিবারের জন্য সেটি হতো লজ্জা আর অসম্মানের বোঝা। তাই অনেকেই সেই কন্যা শিশুকে জীবন্ত কবর দিত। মানুষে মানুষে বিভেদ এতটাই প্রকট হয়ে গিয়েছিল যে, বিনা কারণে বছর বছর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হতো, গোত্রের গৌরব রক্ষায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম ঝরিয়ে দিত রক্ত। সেই সঙ্গে সমাজের অর্থনৈতিক শোষণও ছিল চরমে। ধনীরা সুদের বোঝায় গরিবদের নিঃস্ব করে দিত, বাজারে ছিল প্রতারণা, ওজনে কম দেওয়ার মতো অসংখ্য অন্যায়, যা সবাই জানত, তবু কেউ প্রতিবাদ করত না। আর যারা প্রতিবাদ করত, তারা হয়ে উঠত উপহাসের পাত্র। পাগল, উন্মাদ, গনক, জাদুকর ইত্যাদি নানা নামে তাদের হেয় করা হতো।

প্রথম ওহী : আলোর প্রথম রেখা

ঠিক এমন এক অন্ধকার যুগেই হেরা গুহায় নাজিল হলো প্রথম ওহী- "পড়ো তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। " এই একটিমাত্র বাণী যেন অন্ধকার আকাশে প্রথম আলোকরেখা। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবী ও রাসূল রূপে দায়িত্ব পেলেন। যে দায়িত্ব শুধু নামাজ, রোজা শেখানো নয়, বরং পুরো সমাজকে অন্যায়ের চক্র থেকে বের করে আনা, মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তোলা, মানুষের অন্তরকে শিরক, কুসংস্কার আর হিংসা থেকে মুক্ত করে আল্লাহর দিকে ফেরানো। এই দায়িত্ব সহজ ছিল না, বরং ছিল বিপদসংকুল এক লড়াই, যেখানে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একা হয়ে গিয়েছিলেন পুরো সমাজের বিরুদ্ধে।

সমাজ বদলের লড়াই

‎রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বললেন, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”-আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, তখন এই ডাক সরাসরি আঘাত করেছিল সেই সমাজের অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি সবকিছুর ওপর। কুরাইশ নেতারা অবাক হয়ে বলেছিল, তিনি কি এতগুলো উপাস্যকে এক উপাস্যে পরিণত করেছে? এটা তো এক আশ্চর্য ব্যাপার! তারা বুঝতে পেরেছিল, যদি এই তাওহিদের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে, তবে মক্কার বাণিজ্য ভেঙে পড়বে, গোত্রপ্রথা দুর্বল হয়ে যাবে, মূর্তির পূজা থেকে আসা অর্থ বন্ধ হয়ে যাবে। তাই তারা চেষ্টা করেছিল রাসুলকে থামিয়ে দিতে- প্রলোভন দেখিয়ে, হুমকি দিয়ে, অবশেষে নির্যাতন আর বয়কটের মাধ্যমে।

কিন্তু রাসুল স্রোতে গা ভাসাননি। কর্ণপাত করেননি কারও কটু কথা। নির্যাতনে নিজের শরীর রক্তাক্ত করেছেন। বিকিয়ে দেননি নিজের আদর্শ, নীতি নৈতিকতা ও মহান আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্বকে তাদের হুমকির সামনে। কারও সঙ্গে সমঝোতাও করেননি তাওহীদের বিষয়ে। তিনি চলেছেন তার আপন গতিতে, স্বমহিমায়। তিনি জানতেন, এই সমাজের মূল রোগ শিরক আর নৈতিক অবক্ষয়। তাই সে জায়গাতেই আঘাত করেছিলেন। কারণ একমাত্র তাওহিদই পারে মানুষের হৃদয় থেকে কুসংস্কার আর অন্যায়ের আসক্তি দূর করতে। তার এই আহ্বান ছিল এক বিপ্লব। কারণ তা সমাজের সবচেয়ে বড় শক্তির বিরুদ্ধে ছিল। ছিল শিরক, অর্থের লোভ, বংশীয় অহংকার আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।

নতুন জাহিলিয়াতের যুগ

‎আজ আমরা যখন নিজের চারপাশে তাকাই, দেখি নতুন এক জাহিলিয়াতের রূপ। সেই জাহিলিয়াত আরবের মূর্তিপূজার মতো নয়। কিন্তু ভোগবাদ, নাস্তিক্য, অশ্লীলতা, মিথ্যা, গিবত আর মানুষের মতের পেছনে ছুটে সত্যকে আড়াল করার মানসিকতা - সবই এক ধরনের জাহিলিয়াত। এখনো অনেকেই সত্য বললে ‘পিছিয়ে পড়া’, সেকেলে, ‘মৌলবাদী’ ট্যাগ দেয়, অন্যায়ের বিরোধিতা করলে ‘অতিবাদী’ বলে হেয় করে। দ্বীন ও নববী আদর্শকে আঁকড়ে ধরলে লোকের নানা টিপ্পনী সহ্য করতে হয়। কথিত সভ্য ও সুশীল মানুষের মিথ্যা প্রোপাগান্ডার বিষবাষ্পে দম বন্ধ হয়ে আসে। এ সময় যুব সমাজের সামনে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পথই একমাত্র পথ, যা সত্যকে প্রিয়তর করে মানুষের প্রশংসার চেয়ে, যা দুনিয়ার প্রলোভনকে তুচ্ছ মনে করায় আখিরাতের পুরস্কারের কাছে।

যুব সমাজের করণীয়

‎যুব সমাজকে ফিরে যেতে হবে সেই প্রথম ওহীর বাণীর কাছে, “পড়ো তোমার রবের নামে”। পড়তে হবে, বুঝতে হবে, অন্তরে গ্রহণ করতে হবে সেই আলোর বাণী, যা মানুষের অন্তরকে শুদ্ধ করে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনী পড়তে হবে, শুধু ইতিহাসের গল্প হিসেবে নয়, বরং জীবনের মানচিত্র হিসেবে, যা দেখায় কিভাবে একা হলেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়, কিভাবে মানুষের প্রশংসার চেয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টিকে বড় মনে করতে হয়।

যুব সমাজকে শিখতে হবে, আসল বীরত্ব কীভাবে অন্যায়ের স্রোতে গা না ভাসিয়ে সত্যের পক্ষে অটল থাকা। শিখতে হবে, কিভাবে অর্থ–খ্যাতি–পদমর্যাদার লোভকে অতিক্রম করে ন্যায়–ন্যায্যতাকে প্রাধান্য দেওয়া যায়। নিজেদের বদলাতে হবে কুরআন পড়া, বোঝা এবং জীবনে তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে। নফসের লোভ–লালসা, গিবত, হিংসা, অহংকার থেকে মুক্ত হয়ে, বিনয় আর তাকওয়ার পথে হাঁটতে হবে।

স্রোতের বিপরীতে চলাই আসল বীরত্ব

‎যদি কেউ ভাবে, একা কিছু বদলানো সম্ভব নয়, তবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দিকে তাকাতে হবে। তিনি একাই শুরু করেছিলেন। তারপর সত্য ও ধৈর্যের মাধ্যমে ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার সমাজকেও বদলে দিতে পেরেছিলেন। সেই নূর আজও অম্লান, সেই নূরের উৎস কুরআন–সুন্নাহ আজও আছে। এখন শুধু দরকার সেই নূর অন্তরে ধারণ করার, স্রোতের বিপরীতে হলেও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দৃঢ় থাকার।

আজকের যুবক-যুবতীদের জন্য এই আহ্বান, তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে চলতে ভয় পেও না। মানুষের চোখে ‘পিছিয়ে পড়া’ মনে হলেও মনে রেখো, আল্লাহর কাছে স্রোতের বিপরীতে সত্যের পথে থাকা-ই আসল বীরত্ব। এই নব্য জাহিলি সমাজের কথাকে তোয়াক্কা না করে আলোর পথে ফিরে আসাই নতুন যুগের সবচেয়ে বড় বিপ্লব। আর এই বিপ্লব শুরু হয় নিজের অন্তর থেকে এবং ছড়িয়ে পড়বে অন্তর থেকে অন্তরে, পুরো বিশ্বে, ইনশাআল্লাহ।


0 Comments

Post a Comment

Post a Comment (0)

Previous Post Next Post