সিরাত থেকে শিক্ষা : পর্ব ৫


হিজরত : গুনাহের পরিবেশ থেকে ঈমান রক্ষার পথ

মানুষের জীবন মূলত দুই শক্তির মাঝে টানাপোড়েনের নাম - দ্বীন বনাম দুনিয়া, আল্লাহর আনুগত্য বনাম শয়তানের ফাঁদ। আধুনিক যুগে শয়তানের ফাঁদ আরও সুসংগঠিত ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। মানবজীবন পরীক্ষার ময়দান। প্রতিটি মুহূর্তেই মানুষকে ঘিরে আছে নফস, শয়তান এবং গুনাহর পরিবেশ। বিশেষ করে আধুনিক যুগে গুনাহ যেন চারপাশ থেকে মুসলিমদেরকে  আক্রমণ করছে - অশ্লীলতা, নির্লজ্জতা, সুদ, মাদক, ভোগবাদ, ভ্রান্ত মতবাদ, অমুসলিম সংস্কৃতির আগ্রাসন ইত্যাদি। এমন এক অন্ধকারময় পরিবেশে একজন মুমিনের জন্য ঈমান অটুট রাখা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

কুরআনে মহান  আল্লাহ তায়ালা  বলেন - হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে আর তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর ; যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যাতে মোতায়েন আছে পাষাণ হৃদয় কঠোর স্বভাব ফেরেশতা। আল্লাহ যা আদেশ করেন, তা তারা অমান্য করে না, আর তারা তাই করে, তাদেরকে যা করার জন্য আদেশ দেয়া হয়। (সূরা তাহরীম: ৬)

এই আয়াত আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শুধু নিজেকে নয়; পরিবার ও আগামী প্রজন্মকেও গুনাহর অগ্নিকুণ্ড থেকে বাঁচাতে হবে। আর গুনাহমুক্ত জীবন গড়ার অন্যতম একটি উপায় হলো গুনাহের পরিবেশ, অসভ্য ও অশ্লিলতাপূর্ণ সমাজ ও বিপথগামী বন্ধুদের থেকে হিজরত করা।আল্লাহর জন্য তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা।

হিজরত কী?

‎হিজরত শব্দটির অর্থ হলো - ত্যাগ করা, বিচ্ছিন্ন হওয়া, ছেড়ে যাওয়া।শরীয়তের পরিভাষায় হিজরত বলতে বোঝায় - কুফরি, শিরকি, গুনাহ বা অন্যায়ের পরিবেশ থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে নিরাপদ পরিবেশে চলে যাওয়া।হিজরত বিভিন্ন রকমের হতে পারে। যেমন -

‎১. গুনাহ থেকে হিজরত : অর্থাৎ আল্লাহ যে গুনাহ হারাম করেছেন, তা থেকে দূরে সরে আসা। যেমন মদ, জিনা, সুদ, অশ্লীলতা থেকে দূরে সরে যাওয়া।

‎২. নফস ও শয়তান থেকে হিজরত: নফসের খেয়াল ও শয়তানের ওয়াসওয়াসা ত্যাগ করে আল্লাহর আনুগত্য বেছে নেওয়া।

‎৩. কুফরি পরিবেশ থেকে হিজরত : এমন পরিবেশ থেকে সরে আসা, যেখানে ইসলামী জীবনযাপন সম্ভব নয়।

‎৪. ভৌগলিক হিজরত : ঈমান হেফাজতের জন্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যাওয়া।

‎হিজরতের মূল লক্ষ্য ঈমান রক্ষা। ইসলামের ইতিহাসে হিজরতের বহু দৃষ্টান্ত আছে। তার মধ্যে সাহাবায়ে কেরাম রা.-দের আবিসিনিয়ায় হিজরত একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সেখানে মুসলিমরা দেখিয়েছেন কিভাবে ঈমান রক্ষার জন্য দুনিয়ার মোহ ছেড়ে দূর দেশে চলে যাওয়া যায়। আবার  সেখানে স্থায়ীভাবে না থেকে পুনরায় আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে ফিরে আসা যায়।


‎ সীরাতে হিজরতের ঘটনা

‎ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলমানরা সংখ্যায় অল্প ছিলেন এবং অধিকাংশই ছিলেন দরিদ্র, দাস বা সমাজে প্রভাবহীন মানুষ। কুরাইশ নেতারা বুঝতে পারল যে, যদি এই দাওয়াত ছড়িয়ে পড়ে তবে তাদের মূর্তি পূজার ব্যবসা, সামাজিক প্রভাব ও নেতৃত্ব সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই তারা মুসলমানদের উপর ভয়াবহ নির্যাতন শুরু করে। একইসঙ্গে কেউ ইসলাম গ্রহণ করলেই সামাজিক বয়কট, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ, পরিবার থেকে বহিষ্কার করে দেওয়া হতো।

‎বিলাল রা. তিনি ছিলেন হাবশি দাস। তার মালিক উমাইয়া ইবনে খলফ তাকে প্রখর রোদে বালুর উপর শুইয়ে বুকের উপর ভারী পাথর চাপিয়ে দিত। বলত - মুহাম্মদকে( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অস্বীকার করো।কিন্তু বিলাল রা. দৃঢ়ভাবে বলতেন- আহাদ, আহাদ (আল্লাহ এক, আল্লাহ এক)। হযরত ইয়াসির রা., তার স্ত্রী সুমাইয়া রা. ও তাদের পুত্র আম্মার রা. ছিলেন ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে প্রথমদিককার। ইয়াসির রা. ও সুমাইয়া রা.কে চরম নির্যাতন করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সুমাইয়া রা.-কে আবু জাহল বর্শা মেরে হত্যা করে। তিনি ইসলামের প্রথম শহিদা।ইয়াসির রা.-কেও নির্মমভাবে শহিদ করা হয়।

‎ এ অবস্থায় রাসূল তাদের বললেন,  তোমরা আবিসিনিয়ায় চলে যাও। সেখানে একজন ন্যায়পরায়ণ রাজা আছেন। সেখানে কারো প্রতি জুলুম করা হয় না। ফলে ৫ম নবুওয়াতী বছরে ১১ জন পুরুষ ও ৪ জন মহিলা আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। পরে দ্বিতীয়বার আরও ৮৩ জন পুরুষ ও ১৮ জন মহিলা সেখানে যান। তারা নিরাপদ আশ্রয় পেলেন। রাজা নাজ্জাশি ছিলেন খ্রিস্টান, কিন্তু ন্যায়পরায়ণ। তিনি মুসলিমদের সুরক্ষা দিলেন এবং পরবর্তীতে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।

‎( সিরাত ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড)


‎★বর্তমান সময়ে হিজরতের প্রাসঙ্গিকতা

‎আজকের মুসলিম সমাজে বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠছে। অনেকেই পশ্চিমা দেশগুলোকে উন্নতির প্রতীক ও জীবনের আদর্শ হিসেবে মনে করেন। ফলে উন্নত জীবনযাত্রা ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধার মোহে অনেক মুসলমান নিজেদের দেশ, ইসলামি সমাজ ও পরিবেশ ছেড়ে অমুসলিম দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।

‎অনেকে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশে গেলেও, পরবর্তীতে আর দেশে ফিরে আসেন না। সেখানেই বসতি স্থাপন করেন। অনেকে স্থায়ী নাগরিকত্ব পাওয়ার আশায় আন্তঃধর্মীয় বিয়ে করে ফেলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মদ, মাদক, জেনা-ব্যভিচারসহ নানা অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েন। ফলে বাস্তবতা দাঁড়ায় - যেখানে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ও উন্নত জীবনমান থাকলেও ইসলামি পরিবেশ অনুপস্থিত। নামাজ, রোজা, পর্দা ধীরে ধীরে অবহেলিত হয়ে যায়। সন্তানরা ইসলামী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়, বরং নাস্তিকতা বা খ্রিস্টান সংস্কৃতির ভেতর হারিয়ে যায়। দেখা যায়, প্রথম এক-দুই প্রজন্ম মুসলমান থাকলেও, পরবর্তী প্রজন্ম কেবল নামে-মাত্র মুসলিম পরিচয় ধরে রাখে। চারপাশের কুফরি সমাজে বসবাস করতে করতে তাদের সামনে অমুসলিম হওয়ার আহ্বান আরও প্রবল হয়ে ওঠে।

‎এভাবে বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করা ঈমানের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। একসময় ঈমান নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। প্রকৃতপক্ষে এটি হলো ঈমান বিক্রি করে দুনিয়া কেনা।

‎মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,  নিশ্চয় যারা আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার এবং নিজেদের শপথকে তুচ্ছ মূল্যে বিক্রয় করে, এরা আখেরাতের কোন অংশই পাবে না এবং আল্লাহ কিয়ামাতের দিন তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করবেন না এবং তাদেরকে পবিত্র করবেন না, বস্তুতঃ তাদের জন্য আছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।

‎(সূরা আলে ইমরান: ৭৭)

‎আমাদের সমাজে অনেকেই পড়াশোনার সুবাদে মেসে থাকা কিংবা বড় শহরে ভাড়া বাসায় ওঠে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এসব জায়গার পরিবেশ ঈমান ও আমলের জন্য অনুপযোগী। মেসে বা হোস্টেলে প্রায়শই দেখা যায় অশ্লীল গান-বাজনা, বিড়ি-সিগারেট, গাঁজা, মদের আসর, অবৈধ ভালোবাসার নামে রাত্রি জাগরণ এবং পার্টির নামে বিভিন্ন বেদাতি অনুষ্ঠান। স্বভাবতই মানুষ যেখানে থাকে, সেখানকার পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়। আমি নিজে বহু দ্বীনদার ছেলেকে দেখেছি, যারা কেবল মেসের নোংরা পরিবেশের কারণে ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে গেছে। আবার ঢাকা শহরে দেখা যায়, অনেক বাসায় ভাড়া নেওয়ার শর্ত থাকে - সকাল সাড়ে ছয়টার আগে গেইট খোলা হবে না। ফলে ভাড়াটেদের জন্য ফজরের নামাজে জামাতে অংশ নেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এভাবে একসময় নামাজই বাদ চলে যায়। অথচ মুসলিমের জন্য উচিত হলো, এমন পরিবেশ, এমন মেস কিংবা বাসা সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলা।

‎তদ্রূপ, এমন বন্ধুদেরও বর্জন করা জরুরি, যাদের সঙ্গে চললে গুনাহে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রবল থাকে। কারণ বিপথগামী বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার নামে জেনা-ব্যভিচারের আলোচনা, হারাম ভালোবাসা এবং অশ্লীল আলাপে ডুবে যাওয়াটা খুব সাধারণ ব্যাপার।

‎আল্লাহ তাআলা বলেন,তোমরা সেই ফিতনাকে ভয় কর যা তোমাদের মধ্যকার শুধুমাত্র যালিম ও পাপিষ্ঠদেরকেই বিশেষভাবে ক্লিষ্ট করবেনা। তোমরা জেনে রেখ, নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তি দানে খুবই কঠোর। (সূরা আনফাল : ২৫)

‎এছাড়া মুমিনদের জন্য নির্দেশনা এসেছে,আর তিনি তো কিতাবে তোমাদের প্রতি নাযিল করেছেন যে, যখন তোমরা শুনবে আল্লাহর আয়াতসমূহ অস্বীকার করা হচ্ছে এবং সেগুলো নিয়ে উপহাস করা হচ্ছে, তাহলে তোমরা তাদের সাথে বসবে না, যতক্ষণ না তারা অন্য কথায় নিবিষ্ট হয়, তা না হলে তোমরাও তাদের মত হয়ে যাবে। নিশ্চয় আল্লাহ মুনাফিক ও কাফিরদের সকলকে জাহান্নামে একত্রকারী। (সূরা নিসা : ১৪০)

‎রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  ইরশাদ করেছেন, মানুষ তার বন্ধুর দ্বীনের উপর থাকে। তাই তোমাদের কেউ কাকে বন্ধু বানাচ্ছে তা দেখে নিক।

‎(সুনান আবু দাউদ, হাদিস: 4833; তিরমিজি, হাদিস: 2378)

‎আরেকটি হাদিসে তিনি আরও বলেন, সৎ সঙ্গী ও অসৎ সঙ্গীর দৃষ্টান্ত হলো সুগন্ধি বিক্রেতা ও লৌহকারের মতো। সুগন্ধি বিক্রেতার কাছে গেলে হয়তো সুগন্ধি কিনবে, অথবা অন্তত ভালো গন্ধ পাবে। আর লৌহকারের কাছে গেলে পোশাক পুড়ে যাবে, অথবা অন্তত দুর্গন্ধ পাবেই।

‎(সহিহ বুখারি, হাদিস: 2101; সহিহ মুসলিম, হাদিস: 2628)

‎একইসঙ্গে এমন সমাজ ব্যবস্থাকেও পরিহার করা উচিত যেখানে জাহিলিয়াতকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। যেখানে অমুসলিমদের সংস্কৃতি ও আচার অনুষ্ঠানকে নিজেদের উন্নতি ও অগ্রগতির মানদণ্ড করা হয়েছে।

‎আমরা হয়তো হাজারো সমস্যায় জর্জরিত থাকতে পারি, অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটাতে পারি, কিংবা পশ্চিমাদের কথিত উন্নত জীবন আমাদের ভাগ্যে নাও জুটতে পারে। কিন্তু এসব কিছুর ওপরে সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো - আমরা মুসলিম। আমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং পরকালে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

‎সুতরাং যেখানে আমাদের উচিত ছিল ঈমানকে রক্ষা করার জন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা, সেখানে দুনিয়ার সাময়িক সুখ-সুবিধার লোভে কিভাবে আমরা ইসলামি পরিবেশ, সমাজ ও মূল্যবোধ ছেড়ে কাফের ও মুশরিকদের সঙ্গে বসবাস করতে পারি? কিভাবে নিজের দ্বীনের সঙ্গে আপোষ করতে পারি?

‎রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  সতর্ক করে বলেছেন—“আমি সেসব মুসলিম থেকে দায়মুক্ত, যারা মুশরিকদের মধ্যে বসবাস করে।” (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২৬৪৫)

‎তিনি আরও বলেছেন—“যে ব্যক্তি মুশরিকদের সাহচর্যে থাকে এবং তাদের সঙ্গে বসবাস করে, সে তাদেরই মতো হয়ে যায়।” (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২৭৮৭)

‎প্রিয় ভাই ও বোন, আমাদের জন্য উত্তম পথ হলো সাহাবায়ে কেরামের আদর্শ অনুসরণ করা। প্রয়োজনে বিদেশে গিয়েও নিজের প্রয়োজন পূরণ করে দ্রুত নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করা। গুনাহের পরিবেশ ও সমাজ থেকে হিজরত করে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়া।  দ্বীন রক্ষা করার জন্য এটাই উত্তম ও নিরাপদ পথ। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে দ্বীনের উপর অটল থাকার এবং ঈমানকে সর্বোচ্চ মূল্যবান সম্পদ হিসেবে হেফাজত করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

‎উল্লেখ্য, অমুসলিম দেশে বসবাস করাকে হযরত উলামায়ে কেরাম শর্তসাপেক্ষে বৈধ বলেছেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত হক্কানি কোনো আলেমের শরণাপন্ন হওয়া যেতে পারে।


0 Comments

Post a Comment

Post a Comment (0)

Previous Post Next Post