পর্ব - ১
কী হচ্ছে কুলপতাকে ?
বিশ্ব ইতিহাসে ধর্মপ্রচার কেবল আধ্যাত্মিক আহ্বানে সীমাবদ্ধ ছিল না; এর পেছনে লুকিয়ে ছিল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক আগ্রাসনের সূক্ষ্ম কৌশল। বিশেষ করে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর ছত্রছায়ায় খ্রিস্টান মিশনারিরা যেভাবে দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত এবং নিরুপায় জনগোষ্ঠীর ভেতরে প্রভাব বিস্তার করেছে, তা আজ আর গোপন নয়। সেবা, শিক্ষা ও চিকিৎসার নামে ধর্মান্তরের যে মিশন তারা পরিচালনা করেছে, তা আজ দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট।বিশ্ব ইতিহাসে ধর্মপ্রচারের নামে উপনিবেশবাদ ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বহু ঘটনা রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে খ্রিস্টান মিশনারিরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রেম ও সেবার মুখোশে একটি সুপরিকল্পিত ধর্মান্তর প্রক্রিয়া চালিয়ে আসছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এর ছায়া পড়েছে দীর্ঘকাল ধরে। ময়মনসিংহ বিভাগের নেত্রকোনা জেলার মদন ও আদর্শনগর এলাকায় ঘটে যাওয়া একটি সত্য ঘটনা সেই চিত্রকে বাস্তবরূপে আমাদের সামনে তুলে ধরে।
এক অস্ট্রেলিয়ান দম্পতির আগমন ও মিশনের সূচনা
১৯৩৫ সাল। অস্ট্রেলিয়ার এক খ্রিস্টান দম্পতি, সিরিল জেমস মূর (জন্ম: ১৯১৩) এবং তার স্ত্রী এডনা- তাদের বিবাহ অনুষ্ঠান উদযাপনের জন্য বাংলাদেশের ময়মনসিংহ বিভাগের নেত্রকোনার মদন এলাকাকে বেছে নেন। কারণ, সে এলাকাতেই ছিল তাদের একটি খ্রিস্টান মিশন। সেখানে কিছুলোক খ্রিস্টধর্ম প্রচারের কাজ করতো।
তারা ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে এসে বিয়ের কেনাকাটা সেরে মোহনগঞ্জ আসেন। সেখান থেকে মদন। মোহনগঞ্জ থেকে ট্রলারযোগে মদনে যাওয়ার পথে ছেচড়াখালী নামক স্থানে (বর্তমান নাম আদর্শনগর) ভয়াবহ ঝড়ের কবলে পড়ে ট্রলার ডুবে যায় এবং সেই দম্পতি মারা যান। তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান আর হয়নি, তবে যে জায়গায় অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল সেখানেই তাদের কবর দেওয়া হয়।
প্রায় ২৩ বছর পর, ১৯৫৮ সালে তাদের মরদেহ কবর থেকে তুলে এনে ছেচড়াখালী এলাকায় জমি কিনে সেখানে পুনরায় কবর দেওয়া হয় এবং একটি নতুন মিশন স্থাপন করা হয়। মদন এলাকার পুরনো মিশনটি আশানুরূপ সাড়া না পাওয়ায়, পূর্বে ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের নিয়ে তারা নতুন জায়গা, আদর্শনগরের পাশের কুলপতাক গ্রামে ধর্ম প্রচারের কাজ শুরু করেন।
হাসপাতাল থেকে স্কুল: এক সুপরিকল্পিত মিশন
দুর্গম কুলপতাক গ্রামে যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত কষ্টকর। কিন্তু সেখানেই মিশনারিরা একটি হাসপাতাল স্থাপন করেন। সেই সময়, উপজেলা পর্যায়েও যেখানে ভালো চিকিৎসা পাওয়া দুষ্কর ছিল, সেখানে এই মিশন হাসপাতালে অপারেশন পর্যন্ত করা হতো। চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে স্থানীয়দের আস্থা অর্জন করা হয়, যা ধর্মান্তরের পথকে মসৃণ করে তোলে। পরবর্তীতে হাসপাতালটি বন্ধ করে সেটিকে একটি স্কুলে রূপান্তর করা হয়। এই স্কুল এতটাই আলোচিত হয় যে, ব্রিটিশ হাই কমিশনার এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন সেনাপতি পর্যন্ত সেটি পরিদর্শন করেন। স্কুলের পাশেই রয়েছে আরও কয়েকজন খ্রিস্টান ধর্মযাযকের কবর, যা মিশনের দীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষী।
বর্তমান চিত্র ও ভবিষ্যৎ প্রভাব
২০২৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের একটি টিম সরেজমিনে স্কুলটি পরিদর্শনে গিয়ে যে তথ্য সংগ্রহ করে তা গভীরভাবে চিন্তার বিষয়। স্কুলে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩০৯ জন। এর মধ্যে খ্রিস্টান ৮ জন, মুসলিম ১৫৪ জন, বাকি সবাই হিন্দু শিক্ষার্থী।
স্কুল পরিচালনার টিমে থাকা সকলেই খ্রিস্টান ও হিন্দু ধর্মাবলম্বী।
মিশনারি পরিচালিত স্কুলটি একজন শিশুকে ২২ বছর বয়স পর্যন্ত সম্পূর্ণ তাদের তত্ত্বাবধানে রাখে এবং শিক্ষা, খাদ্য, পোশাক, চিকিৎসা ও চাকরির দায়িত্ব পর্যন্ত তাদের।
২২ বছর ধরে একজন ছেলে বা মেয়ে যখন মিশনের স্নেহ, সহানুভূতি ও নিয়ন্ত্রণে বেড়ে ওঠে, তখন তার মানসিক গঠন, বিশ্বাস ও আদর্শ কোন দিকে গড়াবে,তা সহজেই অনুমান করা যায়। এটি নিছক এক প্রেমময় দম্পতির স্মৃতিচারণ নয়, বরং একটি সুপরিকল্পিত ধর্মীয় প্রভাব বিস্তারের নীরব অভিযান। সেবার মুখোশে দীর্ঘমেয়াদি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও ঈমান বিধ্বংসী কার্যক্রম এখানে স্পষ্ট। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আমাদের সামনে এমন এক বাস্তব চিত্র উঠে আসে, যেখানে দরিদ্র ও অসহায় মানুষের দুর্বলতাকে পুঁজি করে মিশনারিরা তাদের আদর্শ রোপণের কাজ করছে।
প্রিয় পাঠক,একটি জাতির অস্তিত্ব টিকে থাকে তার বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও চিন্তাধারার উপর। যে শিশুদের ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রণে রাখা হয় খ্রিস্টান মিশনারিদের আদর্শ দিয়ে, তাদের হৃদয়ে জন্ম নেয় বিভ্রান্তি। একসময় তারা হয়তো ভুলে যায়, তাদের শেকড়ের নাম। তাদের দ্বারা আমরা কীভাবে দ্বীন বিজয় ও ইসলামের স্বপ্ন দেখতে পারি?
বর্তমান সময়ে এসেও আমরা কি প্রস্তুত এই গোপন মিশনের মোকাবেলায়? আমরা কি পারি না এমন উদ্যোগ নিতে, যেখানে আমরাও এভাবে দরিদ্র শিশুর জীবন গড়তে পারি, শিক্ষা দিতে পারি, চাকরি দিতে পারি আমাদের মূল্যবোধে, আমাদের বিশ্বাসে? আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, তবে হয়তো আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম আর আমাদের মতো থাকবে না।
Post a Comment