আহ্বান : পর্ব ৪

দুনিয়ার ধোঁকায় দ্বীন মানায় আপোষ নয়!

আজকের আধুনিক বিশ্ব একটি অদৃশ্য জালে আটকে আছে।এই জাল হলো বস্তুবাদ, ভোগবাদ ও কর্পোরেট সভ্যতা। মানুষের সফলতা এখন আর নৈতিকতা কিংবা ঈমানদারীর মাপকাঠিতে নির্ধারিত হয় না।  বরং তা নির্ধারিত হয় তার ব্যাংক ব্যালেন্স, গাড়ির ব্র্যান্ড, স্মার্টফোনের মডেল কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার ফলোয়ার দিয়ে। কর্পোরেট সভ্যতায় ধর্ম এখন শুধুই একটি আনুষ্ঠানিকতা, নামাজ এখন সাপ্তাহিক কাজ, রমযান একটি আয়োজন, আর হিজাব ফ্যাশন।  এর বিপরীতে যদি কেউ ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা আঁকড়ে ধরতে চায়, তাহলে তাকে এই সমাজ তাকে  কট্টর বলে ট্যাগ দেয়।সমাজের মূলধারা থেকে পিছিয়ে পড়া ভাবে। এই কর্পোরেট-বস্তুবাদী সংস্কৃতি আমাদের ধীরে ধীরে দ্বীনের মৌলিকত্ব থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের চোখের সামনেই ধীরে ধীরে আপোষের নামে দ্বীনহীনতা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। এটি শুধু কিছু আচার-বিধি বা নামাজ-রোজার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং চিন্তা, বিশ্বাস, সংস্কৃতি, রাজনীতি, আইন, সমাজ - জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এই দ্বীন কোনো মানুষের সৃষ্টি করা নয়। এটি মহান  আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত এক চূড়ান্ত জীবনব্যবস্থা, যা তাওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং, এতে কোনো রকম সংযোজন, বিয়োজন বা আপোষের সুযোগ নেই। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মানবসমাজ কখনোই আল্লাহর দ্বীনকে সহজভাবে গ্রহণ করেনি। বরং প্রতিটি যুগে এই দ্বীনের প্রচারকারীদের সম্মুখে এসেছে কঠিন চ্যালেঞ্জ, প্রলোভন, নির্যাতন এবং  আপোষের আহ্বান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনও এর ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন আপোষহীন ঈমান ও নীতির প্রতীক। তিনি আমাদের এমন এক আদর্শ উপহার দিয়ে গেছেন যা সময় ও পরিস্থিতির ঊর্ধ্বে।

 কেমন ছিল আপোষের সেই প্রস্তাব?

ইসলামের প্রথমদিকে মক্কার কুরাইশরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে গালমন্দ, অপবাদ,নির্যাতন ও সামাজিক বয়কটের মাধ্যমে তাঁর দাওয়াতি কাজকে  থামানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এতে দাওয়াতের গতি কমেনি বরং আরো ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তখন তারা বুঝলো, কঠোরতা নয়, বরং সমঝোতার মাধ্যমে তাঁকে থামানো যেতে পারে। তখনই আসে ইতিহাসের অন্যতম বিখ্যাত ঘটনা - উতবাহ ইবনু রাবীআ’র প্রস্তাব।  কে ছিলেন উতবাহ? উতবাহ ইবনু রাবীআ ছিলেন কুরাইশদের প্রভাবশালী নেতা ও একজন অভিজ্ঞ বক্তা। তার কথা মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যেত। কুরাইশ নেতারা মনে করেছিল, সে-ই উপযুক্ত ব্যক্তি যে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বোঝাতে পারবে, হয়তো তাঁকে প্রলুব্ধ করে থামানো যাবে।

একদিন উতবাহ এসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে একান্তে ডেকে বললেন,হে মুহাম্মদ! তুমি আমাদের সমাজে উচ্চ বংশে জন্ম নিয়েছো, এখন এমন কিছু বলছো যা আমাদের মাঝে ফাটল ধরিয়েছে। এবার শোনো, আমি তোমাকে কিছু প্রস্তাব দিচ্ছি, যদি এগুলো গ্রহণ করো, তবে তাতে তোমারই মঙ্গল হবে।

‎যদি তুমি এই কাজের মাধ্যমে ধন-সম্পদ চাও, আমরা তোমাকে এত ধন দান করব যে, গোটা মক্কায় তুমি সবচেয়ে ধনী হয়ে যাবে। যদি তুমি মর্যাদা চাও, আমরা তোমাকে নেতা বানাবো। এমনকি তোমাকে আমাদের রাজা পর্যন্ত করে দেবো। যদি তুমি কোনো সুন্দরী নারী চাও, আমরা তোমার পছন্দের নারীকে তোমার সঙ্গে বিবাহ দিয়ে দেবো।আর যদি তুমি মনে করো, তোমার ওপর জ্বিন এসেছে বা তুমি অসুস্থ, তবে আমরা সর্বোত্তম চিকিৎসকের কাছে তোমাকে নিয়ে যাবো। যত খরচই হোক, আমরা দেব।

উতবাহ তার সব কথা বলে থামলেন এবং ভাবলেন নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবার নিশ্চয় কিছু না কিছু মানবেন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উতবাহর সব কথা শুনে বললেন,এখন কি তুমি শুনবে? উতবাহ বললেন, হ্যাঁ, আমি শুনছি।

তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূরা ফুসসিলাতের প্রথমাংশ তিলাওয়াত করতে শুরু করলেন। এই আয়াতগুলো এমন ছিল যে উতবাহ স্তব্ধ হয়ে যান। তার মুখ বিবর্ণ হয়ে পড়ে, হাত কাঁপতে থাকে। আয়াতগুলো তার অন্তর কাঁপিয়ে দেয়। তিনি কোনো জবাব না দিয়ে কুরাইশদের কাছে ফিরে যান।

যখন উতবাহ ফিরে এল, কুরাইশ নেতারা বলল,তোমার মুখের অবস্থা বদলে গেছে, তুমি যেভাবে গিয়েছিলে, সেভাবে তো আর ফিরলে না! উতবাহ বললেন, আল্লাহর কসম! আমি এমন কিছু শুনেছি, যা আমি জীবনে কখনও শুনিনি। এটা কবিতা নয়, জাদু নয়, গণকতন্ত্র নয়। হে আমার সম্প্রদায়, মুহাম্মাদকে তার পথে থাকতে দাও। তার প্রতি কোনো বাধা দিও না। যদি সে জিতে যায়, তাহলে তার বিজয় তোমাদেরও হবে। আর যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে তোমাদের কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু কুরাইশরা বলল, তোমাকেও সে মোহিত করেছে!

উতবাহর সেই প্রস্তাব আজ ইতিহাস, কিন্তু তার ধরন ও কৌশল এখনো জীবিত। আজও শয়তান ও তার অনুসারীরা উতবাহর প্রস্তাবের নতুন সংস্করণ নিয়ে হাজির হচ্ছে। পার্থক্য শুধু ভাষা ও পরিবেশে। কেউ সরাসরি বলে না, ধন-সম্পদ দিই, দ্বীন ছেড়ে দাও। বরং আজ বলা হয়, তুমি চাকরি করতে চাও? তাহলে হিজাবটা একটু ঢিলে করো। নেকাবটা খুলে ফেল। দাড়িটা কেটে ফেল। তুমি জনপ্রিয় হতে চাও? ইসলামি পরিচিতি লুকিয়ে রাখো। তুমি প্রতিষ্ঠিত হতে চাও? দ্বীনের বিষয়ে কিছুটা নমনীয় হও। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা থেকে শুরু করে কর্পোরেট অফিস, সবখানে যেন এক অদৃশ্য চুক্তি - ইসলামি চিন্তা ও চেতনা সঙ্গে রাখো বটে, তবে প্রকাশ করোনা। কর্মস্থলে নামাজের কথা বললে অসহনশীল, পোশাকে পর্দা করলে পিছিয়ে পড়া, ইসলামী চিন্তা প্রকাশ করলে সেকেলে বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়।  এই চাপে পড়ে অনেকেই দ্বীনকে একপ্রকার ব্যক্তিগত ও অদৃশ্য বিষয়ে রূপান্তরিত করেছে। অথচ ইসলাম তো কেবল ব্যক্তিগত সাধনার ধর্ম নয়। বরং তা এক পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ জীবনবিধান ও  সমাজব্যবস্থা।

আজকের কর্পোরেট সভ্যতা আমাদের এমনভাবে গড়ে তুলছে যেন আমরা দ্বীনের মূল শিক্ষা তাওহীদ, তাকওয়া, পরকালের জবাবদিহিতা - এসব ভুলে যাই। আমাদের সফলতার মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্যারিয়ার, ডিগ্রি, কোম্পানির নাম ও মাসিক ইনকাম। দুনিয়ার এই মোহে পড়ে আমরা আমাদের ঈমানকে জলাঞ্জলি দিচ্ছি, যেমনটি কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,কিন্তু তোমরা তো দুনিয়ার জীবনকেই প্রাধান্য দাও,অথচ আখিরাতই অধিক উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী। (সূরা আল-আ’লা: ১৬-১৭)

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যেখানেই দ্বীনের ক্ষেত্রে আপোষ করা হয়েছে, সেখানেই ঈমানের ক্ষতি হয়েছে। আজ সমাজে অনেকেই আছেন যারা ইসলামকে ভালোবাসেন, কিন্তু দুনিয়ার সুবিধার জন্য দ্বীনের মৌলিকতাকে বিসর্জন দেন। তারা নামাজ ছাড়েন যাতে কোম্পানির মিটিং না মিস হয়, তারা সুদের চাকরি গ্রহণ করেন যেন পরিবারকে ভালো রাখা যায়, তারা পর্দাহীনতা গ্রহণ করেন যেন স্মার্ট মনে হয়। এভাবে এক সময় অন্তরটা একেবারে মরে যায়। তাওহীদের স্বাদ হারিয়ে যায়।

দ্বীনের ক্ষেত্রে আপোষ কখনো ক্ষুদ্র বিষয় নয়, বরং এটা এক ভয়ংকর শুরু, জেনেশুনে বিষপান করার মতো । আজ ছোটটুকু ছাড় দিলে কাল বড় ছাড় সহজ হয়ে যায়। আজ একটু হিজাব ছাড়লে কাল পোশাকটাই বদলে যায়। আজ শুধু এক মিটিংয়ের নামাজ ছেড়ে দিলে একসময় পুরোদিন নামাজহীন হয়ে যায়। মহান আল্লাহ  তায়ালা বলেন, তারা চায় যেন তুমি নমনীয় হও, তাহলে তারাও নমনীয় হবে।(সূরা কলম: ৯)

আমরা দ্বীনি বিষয়ে কীভাবে হবো আপোষহীন?

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের শিখিয়েছেন, ঈমানের প্রশ্নে কোনো ছাড় নেই। তিনি বলেছেন,আল্লাহর কসম! যদি তারা আমার এক হাতে সূর্য ও অন্য হাতে চাঁদও ধরিয়ে দেয়, তবুও আমি এই দ্বীনের দাওয়াত থেকে সরে আসব না, যতক্ষণ না আল্লাহ তা বিজয়ী করেন অথবা আমি এতে ধ্বংস হয়ে যাই! উতবাহ তাকে যে লোভনীয় প্রস্তাব দিয়েছিল, তা তিনি পদদলিত করে দেখিয়েছেন সত্য ও ন্যায়ের পথে আপোষ নয়।

এই দৃঢ়তা আমাদের হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। সর্বদা মনেপ্রাণে স্মরণ রাখতে হবে,আমি মুসলমান। আমি ঈমানদার। ইসলামের প্রতিটি বিষয়,হুকুম আহকাম আমার ঈমানের অংশ। এর উপরই নির্ভর করছে আমার দুনিয়াতে শান্তি ও আখিরাতে মুক্তি। তাই আমি কখনই ঈমানের সঙ্গে আপোষ করতে পারি না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে উতবাহর প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিলেন, ফিরিয়ে দিয়েছিলেন কুরাইশ প্রতিনিধিদের, সে চেতনা আমাদের হৃদয়ে ধারন করতে হবে। মনে রাখতে হবে দুনিয়াতে সাময়িক দুঃখ,কষ্ট পেলেও আখিরাতে এর জন্য রয়েছে অজস্র সওয়াব ও প্রতিদান, রয়েছে জান্নাত।

0 Comments

Post a Comment

Post a Comment (0)

Previous Post Next Post