হাওরের পানিতে ডুবে থাকা ঈমান : একটি হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতা
২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়। সারা দেশের মতো সুনামগঞ্জেও নেমে এসেছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ—উজানের পানিতে সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যা। সুনামগঞ্জ জেলার অন্তর্গত একটি জনপদ ধর্মপাশা, যা মূলত হাওর অধ্যুষিত এলাকা। এখানকার মানুষের জীবন বর্ষাকালে যেন পানির সঙ্গে এক গভীর সংগ্রামের নাম। যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা, শিক্ষা-দীক্ষা ও দাওয়াতি কার্যক্রমের অভাব—সবকিছু মিলে একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন বাস্তবতা।
আমরা কয়েকজন সাথী মিলে সফরের পরিকল্পনা করলাম—হাওরের মাঝখানে পানিবেষ্টিত এই এলাকাগুলোর মানুষ কেমন আছে, তারা দ্বীন সম্পর্কে কতটুকু জানে, শিশুদের ঈমানি হালত কেমন? এসব জানাই ছিল উদ্দেশ্য।
পানির মাঝে নৌকা ভাসিয়ে চলছিলাম। কোনো গাছের গলা পর্যন্ত পানি, কোনো কোনো জায়গায় ঘরবাড়ি প্রায় পুরোপুরি ডুবে গেছে। দূরে দ্বীপের মতো ভেসে থাকা বাড়িগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল - আহ!জীবন কত অসহায় এখানে।
আমাদের নৌকা এসে থামে শিমের খাল নামক জায়গায়। সেখানকার স্থানীয় মসজিদের সামনে লোকজন ও বাচ্চাদের ডেকে আনি। সবার মধ্যে একধরনের আগ্রহ ছিল—নতুন মানুষ এসেছে, কী বলবে শুনতে হবে।
★হৃদয়বিদারক মুহূর্ত
আমরা শিশুদের কয়েকটি সাধারণ প্রশ্ন করি—
কে কে কালিমা জানো?সবাই একসঙ্গে বলে—জানি না। আমরা ভাবলাম—বাচ্চারা ছোট, হয়তো তাই না জানে। তাই আবার জিজ্ঞেস করলাম—আমাদের নবীজির নাম কী? উত্তর আসে—জানি না। পরে জিজ্ঞেস করা হয়—তোমাদের ধর্মের নাম কী? একই উত্তর—"জানি না।"
সেই মুহূর্তে আমাদের চোখ ভিজে যায়। কান্না ধরে রাখা যায় না।এরা আমাদের সন্তান। অথচ কেউ জানে না কালিমা, কেউ চেনে না রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। নিজের ধর্মের নামও তারা জানে না! কী ভয়াবহ বাস্তবতা! আমরা শহরে বসে সভা করি, সেমিনার করি, কনফারেন্স করি। অথচ কয়েক কিলোমিটার দূরের এই মানুষগুলো ইসলামের মৌলিক জ্ঞান থেকেও বঞ্চিত!
এরপর আমরা এক সাথীকে দিয়ে বাচ্চাদের কালিমা শেখানো শুরু করি। নবীজির নাম মুখস্থ করানো হয়। বাচ্চাদের বলি—বাসায় গিয়ে আম্মার কাছে আরও শিখবা। তখন পাশ থেকে এক মা বলে উঠলেন—আম্মা নিজেই তো জানে না, শিখাবে কী করে?আবার এক ধাক্কা লাগল হৃদয়ে।
★স্থানীয় ইমামের বর্ণনা ও মিশনারি কার্যক্রম
সেখানকার ইমাম সাহেবের সঙ্গে কথা বলি। উনি বৃদ্ধ একজন মানুষ। একটু পড়াশোনা করেছেন নোয়াখালী অঞ্চলের কোনো এক হুজুরের কাছে- আলিফ,বে, তে,ছে। তিনি বলেন—বর্ষাকালে খ্রিস্টান মিশনারিরা নৌকা করে আসে। বাচ্চাদের ডাকে, কিছু গল্প শোনায়, বাইবেলের কথা বলে। তারপর দেয় ডিম, বিস্কুট, কলা।
“আমি নিষেধ করি, কিন্তু কেউ শোনে না। বলে, যাবে না কেন? খালি পেটে দুই ঘণ্টা বসে থাকলেও তো কেউ কিছু দেয় না । এরা কিছু দেয়, তাই ওরা যায়—ইমাম সাহেবের কণ্ঠে অসহায়তা। শুধু বাচ্চাদের মাঝেই না, মিশনারি এনজিওগুলো মহিলাদেরও লক্ষ্যবস্তু করছে। উঠান বৈঠকের নামে দিচ্ছে সুদের ফাঁদ, স্বাবলম্বী করার নামে দিচ্ছে পরিবারভাঙার পাঠ। বলছে—তুমি কেন স্বামীর অধীনে থাকবে? নিজের পায়ে দাঁড়াও।
★ শিশুদের মুখে যীশু নবী
ইমাম সাহেবের বর্ণনার পর, এক শিশুকে জিজ্ঞেস করলাম—যীশু সম্পর্কে কিছু জানো? সে বললো—হ্যাঁ, উনি একজন নবী। তিনি আবার আসবেন।
আমরা হতবাক। প্রশ্ন করলাম—তুমি আমাদের নবীর নাম জানো? সে বললো—না।
আল্লাহ! কী করুন অবস্থা আমাদের সন্তানদের! যীশুকে চেনে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে না চেনে! ঈমানের এই মর্মান্তিক দুরবস্থা দেখলে কার হৃদয় না কাঁদে?
শুধু শিমের খাল না— প্রায় প্রতিটি হাওরগ্রামে এমনই অবস্থা। আমরা কয়েকটি গ্রামে সফর করি। প্রতিটি গ্রামে গিয়ে একই চিত্র পাই—ঈমানহীনতা, অজ্ঞতা, হাহাকার। হাওরের পানিতে নয়, এখানে মানুষ ডুবে আছে অজ্ঞতার স্রোতে, ঈমানহীনতার জলজটে।
★ আমাদের সবার প্রতি আহ্বান:
প্রিয় মুসলিম ভাই ও বোনেরা, যে বাচ্চারা কালিমা জানে না, নবীজির নাম জানে না—তারা কারা? তারা আমাদেরই সন্তান। আমরা দাওয়াতের কাজকে শুধু শহর কেন্দ্রিক সীমাবদ্ধতায় রেখে দিয়েছি। অথচ গ্রামগুলোতে ঈমান বিধ্বংসী মিশন চলছে। হাওরের মানুষগুলোর হৃদয়েও এক পিয়াসা আছে—জানার, শোনার, বোঝার।
আজ যদি আমরা তাদের কাছে না যাই, তাহলে অন্য কেউ যাবে—যেমন মিশনারিরা যাচ্ছে। আজ যদি আমরা আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত না দিই, কাল তারা অন্য দ্বীনের কথা শিখবে। আমরা যদি আগলে না রাখি, শয়তান তাদের আগলে রাখবে।
এখনই যদি আমরা হাওরের পানিতে ইসলামের নৌকা না ভাসিয়ে দেই, ঈমানহীনতার বন্যায় ভেসে যাওয়া সন্তানদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা না করি আল্লাহর দিকে, তাহলে এই শিশুদের কান্না যেন আখিরাতে আমাদের গলার ফাঁস না হয়। এই মায়েদের অজ্ঞানতা যেন আমাদের গাফেলতার সাক্ষী না হয়। এই বৃদ্ধ ইমামের অসহায় চাহনি যেন আমাদের আখিরাতকে যেন বরবাদ না করে দেয়।
★ এখন কী করব আমরা?
১. গ্রামে গ্রামে দ্বীন শেখানোর ব্যবস্থা: শহরে বসে সভা-সেমিনার যথেষ্ট নয়। আমাদের ফিকির এখন হাওরপারের দিকে বাড়াতে হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষক পাঠাতে হবে। ছোট ছোট মক্তব করতে হবে, যেন অন্তত বাচ্চারা কালিমা জানে। ঈমানকে জানে, বুঝে।
২. ইমামদের প্রশিক্ষণ: স্থানীয় ইমামদের কুরআন-হাদীস, তাজবীদ, বুনিয়াদি দাওয়াতি ট্রেনিং দিতে হবে। যেন তারা নিজেরা দ্বীনের দাওয়াত দিতে পারে।
৩. মহিলাদের জন্য বিশেষ প্রোগ্রাম: ঈমান, পর্দা ও ইসলামী জীবনব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে মহিলাদের জন্য আলাদা পাঠচক্র গঠন করতে হবে। এনজিওদের বদলে আমাদেরই হতে হবে তাদের ভরসাস্থল।
৪. খাদ্যদ্রব্য সহায়তা ও দ্বীনি শিক্ষা একসাথে: শিশুরা যে কারণে মিশনারিদের কাছে যায়—ডিম, বিস্কুট, খাবার। আমরাও দ্বীনের পাশাপাশি তাদের ক্ষুধার দিকেও নজর দিতে হবে।
৫. স্থানীয় যুবকদের দাওয়াতি কাজে সম্পৃক্ত করা: হাওরেরই শিক্ষিত কিছু যুবককে দাওয়াতি কাজে সম্পৃক্ত করে সারা বছর তাঁরা যেন নিজের এলাকায় দ্বীনের কাজ চালিয়ে যেতে পারে—এই ব্যবস্থা করতে হবে।
হে আল্লাহ! আমাদের হৃদয়কে তোমার ভালোবাসায় পূর্ণ করো এবং এই মহান দ্বীনের ভার আমাদের কাঁধে বহন করার তাওফিক দাও। আমীন!
Post a Comment